বকশীগঞ্জ প্রতিনিধি ।।
সঞ্জু মিয়া ও তাহমিনার সফলতার কারণেই পাল্টে গেছে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার পাখীমারা গ্রামের নাম। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাখীমারা গ্রামের নাম “জামদানি গ্রাম”বা “জামদানি পল্লী” নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। শুধু তাই না পাল্টে যাচ্ছে জামদানি গ্রামের মানুষের পেশাও।
বাবা হালিম সরকারের মুত্যুর পর সংসারে ভাতের অভাবে বিধবা মায়ের হাত ধরে এক সময় পাখীমারা গ্রাম ছেড়ে ঢাকার ডেমরা গিয়ে ছিলেন কিশোর সঞ্জু মিয়া। ডেমরায় জামদানি পল্লীতে হেলপার হিসেবে সামান্য বেতনে কাজ শুরু করেন। শুরুতেই সফলতার স্বপ্ন নিয়ে সঞ্জু মিয়া কাজ করতে থাকেন। অল্প দিনেই হয়ে উঠেন একজন দক্ষ জামদানি কারিগর। পরে স্বপ্ন পুরণের জন্য ঢাকার ডেমরা থেকে চাকরি ছেড়ে ২০০৪ সালে সঞ্জু মিয়া ছুটে আসেন পৈতৃক নিবাস পাখিমারা গ্রামে।
কারিগর, হেলপার, সুতা ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশে মাত্র একটি তাঁত নিয়ে জামদানি তৈরির কাজ শুরু করেন সঞ্জু মিয়া। এরপর দক্ষ জামদানি কারিগর স্ত্রী তাহমিনা বেগমের সহযোগিতায় তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জামদানি দম্পতির হাত আর পায়ের নিপুনতায় মনের মাধুরী মিশিয়ে বাহারি রঙের শাড়ি, বৈচিত্রময় ডিজাইন, নজরকাড়া কারুকাজ ও নতুনত্বের ছোঁয়ায় তৈরি করতে শুরু করেন জামদানি শাড়ি।
মান ভালো থাকায় পাইকারি ও খুচরা উভয় শ্রেণির ক্রেতার সুনজরে পড়ে সঞ্জু-তাহমিনার তাঁতের তৈরি জামদানি শাড়ি। প্রসারিত হয় বাণ্যিজিক বাজার। শুধু দেশে নয় দেশের মানচিত্র পেরিয়ে ভারতসহ বিদেশের বিভিন্ন বাজারেও কদর বাড়ে সঞ্জু-তাহমিনার জামদানি। বাড়ে জামদানির চাহিদা। চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে ব্যবসার প্রসারও ঘটাতে বাধ্য হন সঞ্জু মিয়া। বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে বাহারি রঙের বকশীগঞ্জের তাঁতের শাড়ি। এরই মধ্যে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারদের পাশাপাশি খুচরা ক্রেতারাও শাড়ি কিনতে ভিড় করছেন পাখিমারা তাঁতপল্লীতে।
স্বামী স্ত্রী মিলে মাত্র একটি তাতঁ দিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমান চিত্র ভিন্ন। সঞ্জু তাহমিনার জামদানি কারখানায় এখন তাতেঁর সংখ্যা ২০টি। বর্তমানে ৫০ জন শ্রমিক তার অধীনে জামদানি তৈরির কাজ করছেন। ৫০ জন শ্রমিককে তিনি প্রতিমাসে বেতন দেন প্রায় তিন লাখ টাকা। প্রতিমাসে কারখানায় তৈরি হয় শতাধিক শাড়ি। প্রতিটি শাড়ির দাম সাত হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। তবে অর্ডার পেলে এর চেয়েও বেশি দামের শাড়ি তৈরি হয় সঞ্জুর জামদানি কারখানায়।
পাখিমারা গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা ছিলো দিনমজুরি আর বাঁশ শিল্প। সে পাখিমারা গ্রাম এখন তাঁত এর খটখট শব্দে কর্মমুখর থাকে সবসময়। সঞ্জু ও তার স্ত্রীর তাহমিনার তাঁতের কাজ শিখে শতাধিক জামদানি তাঁত গড়ে উঠেছে পাখীমারা গ্রামে। প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ বেকারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে। সঞ্জু ও তাহমিনার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে একই গ্রামের আনারুল ইসলাম, খোকা মিয়া, সবুজ মিয়া, রমজান আলী, মমিন মিয়া ও শিপন মিয়াসহ বিভিন্ন জনে প্রায় শতাধিক তাঁত প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিটি তাঁতে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের জামদানি শাড়ি। সবার ব্যবসা জমজমাট।
সঞ্জু মিয়া জানান,সততা এবং স্বপ্নের প্রতি আস্থা থাকার কারণে আমি সফল হয়েছি। আমার পরিবারের কষ্ট দূর হয়েছে। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে খুব সুখে আছি।
সঞ্জু মিয়ার স্ত্রী তাহমিনা বেগম জানান, এক সময় পুঁজির জন্য বিভিন্ন বাংক এবং এনজিও’র এর কাছে ধর্ণা দিতাম। কিন্তু এখন বিভিন্ন ব্যাংক এবং এনজিওর ঋণ দেয়ার জন্য আমাদের পেছনে ঘুরে।
তিনি আরো বলেন বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হলে শুধু আমাদের না এ গ্রামের প্রতিটি পরিবারের জীবন যাত্রার মান পাল্টে যাবে।
বকশীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম সওদাগর জানান,এ জামদানি পল্লী নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। ঐতিহ্যবাহী এ জামদানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও ঋন সহযোগিতার প্রয়োজন। সরকারি সহযোগীতা পেলে জামদানি শিল্পের প্রসার হবে।
3/related/default