নিজস্ব প্রতিবেদক॥
জামালপুর জেলার ৭টি উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন বছরের তিন মাস অতিক্রান্তের পর এপ্রিল থেকে এখানে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন বই সংযোজন করা হয়। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এসব বই কিনতে বাধ্যও করা হয়। জানা যায়, এখানে প্রথম শ্রেণিতে বাড়তি যোগ হয়েছে বই। ফলে প্রথম শ্রেণির শিশুদের এখন পড়তে হচ্ছে ছয়টি বই। প্রতিটি ক্ষুদে শিক্ষার্থীকে এসব বইয়ের সঙ্গে আরও ছয়টি খাতা, ডায়েরি, সিলেবাস, টিফিন বক্স ও কমপক্ষে এক লিটার পানি বহন করতে হচ্ছে। সবমিলে ৭-৮ কেজি ব্যাগের ভার বহন করতে হচ্ছে শিশুদের। এ চিত্র কেবল জামালপুরে নয়, ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। প্রতিদিন সকালে দেখা যায়, শিশুদের ভারী ব্যাগ বহন করে স্কুলে যেতে হচ্ছে। অথচ শিশুদের বইয়ের বোঝা কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। আড়াই বছর আগে সর্বোচ্চ আদালতের এ সংক্রান্ত একটি রায়ও আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আদালতের ওই আদেশ প্রতিপালনের দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো বই পড়ানোর সুযোগ নেই, হয়ও না। তবে নামিদামি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রাথমিক স্তরে অতিরিক্ত বই পড়ানো হয়। ওইসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। আশা করি, তারা বিষয়টি মনিটরিং এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত অখ্যাত লেখকের বই পাঠ্যভুক্ত করা হচ্ছে। বইগুলোর দামও বেশ চড়া। জামালপুরের বিভিন্ন স্কুলের প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির ২৫ ক্ষুদে শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাদের গড় ওজনের ২০ শতাংশের বেশি ওজন স্কুলব্যাগের। সরকারের দেয়া বইয়ের সঙ্গে স্কুল থেকে দেয়া সহায়ক বই এবং প্রতিটি বিষয়ের বিপরীতে সর্বোচ্চ তিনটি পর্যন্ত খাতা বা ডায়েরি মেলে তাদের ব্যাগে। পাশাপাশি ব্যাগের ওজনের সঙ্গে যোগ হয় টিফিন বক্স ও কমপক্ষে এক লিটার পানি। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে স্কুলের আগে ও পরে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য কোচিং-সহায়ক বই ও খাতা থাকায় ওজন আরও বেড়ে যায়। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হাতে বাড়তি বই তুলে দেয়া হয়েছে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সাধারণ জ্ঞান, পরিবেশ পরিচিতি, বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার জুড়ে দেয়া হয়েছে। অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে এসব বই কিনে সন্তানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। এখানে নার্সারি ও কেজি স্তরে ১০ থেকে ১১টি বই পড়ানো হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরের প্রতিটি ক্লাসেই বাড়তি বইয়ের বোঝা বহন করতে হচ্ছে শিশুদের। নার্সারি ক্লাসে ১০টি বইয়ের মধ্যে রয়েছে- শিশুদের বাংলা পড়া, লেখা শেখা, ছড়া বই, ইংলিশ, অক্ষর চেনা, ইংরেজি গ্রামার, সংখ্যা শিক্ষা, অংক, ছবি আঁকা ও আরবি শিক্ষা। কেজিতে আমার সাথী বাংলা বই, এসো লেখা শিখি, ইংরেজি গ্রামার, মাই পিকচার ওয়ার্ড, মজার পড়া, অংক শেখা, পরিবেশ পরিচিতি, নৈতিক শিক্ষা, এসো রং নিয়ে খেলা করি, আদর্শ হিন্দু ধর্ম শিক্ষা; প্রথম শ্রেণিতে ইংরেজি গ্রামার, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, সাধারণজ্ঞান, আদর্শ হিন্দু শিক্ষা ও ছবি আঁকা; দ্বিতীয় শ্রেণিতে সহজ বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা, ইংরেজি গ্রামার, রাফি ইউজফুল ওয়ার্ডবুক, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, আরবি ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, আদর্শ হিন্দু শিক্ষা, এসো ছবি আঁকি ও রং করি; তৃতীয় শ্রেণিতে নতুন বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ইংরেজি গ্রামার, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, এসো ছবি আঁকি ও রং করি; চতুর্থ শ্রেণিতে বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় ও রাফির ছবি আঁকা ও রং করা এবং পঞ্চম শ্রেণিতে আমার বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ইংরেজি ব্যাকরণ বই পড়ানো হচ্ছে। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রাথমিক স্তরের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিষেধ করে সুনির্দিষ্ট একটি আইন প্রণয়নে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ আইন করতে আইন সচিব, শিক্ষা সচিব, গণশিক্ষা সচিবসহ বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেন। রায়ে আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাথমিকে যাওয়া শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করা যাবে না- নতুন করে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়। ৩০ দিনের মধ্যে ওই সার্কুলার জারি করতে বলা হয়। এটি তদারকির জন্য সেল রাখা, ব্যর্থ হলে কী শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে, তা-ও উল্লেখ করতে বলা হয়। অন্যথায় এর দায়ভার গণশিক্ষা সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে বহন করতে হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষকসহ অংশীজনের সচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিতে বলা হয়। প্রাথমিকে শিশুদের ব্যাগ বহনে সুনির্দিষ্ট আইন, বিধিমালা ও নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়েরকারী তিন আইনজীবীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাসুদ হোসেন দোলন। তিনি বলেন, শিশুর শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিয়ে আদালতের আদেশের দুই বছরের অধিক সময় পার হলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের পক্ষ থেকে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়। আদালত এ বিষয়ে রুল জারি করেন। আশা করছি, অবকাশকালীন ছুটির পর শুনানি হবে। তিনি বলেন, আদালতের আদেশের গুরুতর লঙ্ঘন চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। আদালতের নির্দেশের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাগে সরকার অনুমোদিত বই ও উপকরণ ছাড়া অন্যকিছু না দিতে সবাইকে সতর্ক করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। পরিপত্রে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ব্যাগে অনুমোদিত বই-উপকরণ ছাড়া অন্যকিছু বিদ্যালয়ে আনতে নিরুৎসাহিত করতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, আট বিভাগের (প্রাথমিক শিক্ষা) উপ-পরিচালক; জেলা, উপজেলা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেনডেন্টদের (তত্ত্বাবধায়ক) নির্দেশনা দেয়া হয়। এদিকে আদালতের ওই আদেশের পর সরকার সার্কুলার জারি করলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। সার্কুলারে তদারকি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ নেই। ২০১৯ সালে এসেও দেখা যাচ্ছে, নিজেদের ওজনের তুলনায় অনেক ভারী ব্যাগ বয়ে চলছে শিশুরা। অভিভাবক, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়- সবার জ্ঞাতসারে ভারী ব্যাগের বোঝা বহন করতে হচ্ছে শিশুদের। এখন প্রশ্ন উঠেছে, শিশুদের ভারী ব্যাগের বোঝা হালকা হবে কবে? এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মোঃ আজহারুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগের কারণে শিশুরা মেরুদ- ও হাড়ের বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। ভারী ব্যাগ বহনের ফলে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক অসুস্থতায় পড়তে পারে শিশুরা। এটি চলতে থাকলে দেশ গড়ার ভবিষ্যৎ কারিগরদের নিয়ে তো শঙ্কা দেখা দেবে! ঢাকায় অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরাম’র সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিশুর ব্যাগের ওজন যেন বেশি না হয়। তারপরও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, বইয়ের কারণে ব্যাগের ওজন বাড়ে না। বইয়ের সঙ্গে প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য একটি করে খাতা বহন করতে হচ্ছে। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ডায়েরিও। এসব বন্ধে উচ্চ পর্যায়ের একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা দরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অতিরিক্ত কোনো বই ক্লাসে পড়ানো যাবে না। যদি কেউ তা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয় তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তিনি বলেন, এমন অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ী প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিলসহ পাঠদান অনুমোদনও বাতিল করা হতে পারে। সার্কুলার জারির পরও কেন এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর সহায়তা ছাড়া আদালতের আদেশ ও সরকারি সার্কুলার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
3/related/default