বছরে পাচার হাজার কোটি টাকা ॥ প্রযুক্তির অপব্যবহারে অপরাধ বাড়ছে

Joynal Abdin
0

অনলাইন ডেস্ক ।।

ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট এখন বেশ সহজলভ্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং স্মার্ট ফোনের সহজপ্রাপ্যতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহারেই বাড়ছে বিভিন্ন অপরাধ। অনলাইনে চলছে মাদক বেচাকেনা। তরুণ-তরুণীরা লাইকি-টিকটকের অশ্লীল ভিডিওতে নাচ, গান ও অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেদের ধূমপান ও সিসা গ্রহণ করার ভিত্তিও আপলোড করেছেন। ‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেমে কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ভয়ঙ্কর আসক্তি তৈরি করছে। এ দুটি গেম শিক্ষার্থী-কিশোর-কিশোরীদের সহিংস করে তুলছে। ‘বিগো লাইভ’ ও ‘স্ট্রিমকার’ এ্যাপ দিয়ে যৌনতার ফাঁদে ফেলে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। দেশের বাইরে থেকে এসব এ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করায় হোতারা রয়ে গেছেন আড়ালে। তবে বাংলাদেশে এ্যাপ দুটি পরিচালনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। রবিবার সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি জানিয়েছে, প্রতি মাসে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা। এতে বছরে গিয়ে দাঁড়ায় হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ‘তিন পাত্তি গোল্ড’সহ বিভিন্ন অনলাইনে প্রতিনিয়ত জুয়া খেলে হুন্ডিতে অর্থ লেনদেন করছে বিভিন্ন চক্র। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর বহু দেশ এসব এ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশেও এসব এ্যাপ নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিরাপদে রাখতে আইন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করার দাবি জানান তারা। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির এক প্রতিবেদন বলছে, গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চ মাসে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩৪ লাখ ২৫ হাজার। এতে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজারে। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড (আইএসপি ও পিএসটিএন) ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা মাত্র ৯৮ লাখ ১০ হাজার। বাকি ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রয়েছেন তরুণ সমাজ। কিন্তু এর অপব্যবহারের কারণে দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। বাবা-মার উৎসাহ বা অবহেলার কারণে শিশুরা খুব কম বয়সে বিভিন্ন গেমে আসক্ত হচ্ছে। করোনাকালে কিশোরদের অপরাধ প্রবণতাসহ গ্যাং কালচারের আসক্তি বেড়েছে। লকডাউনে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের অপরাধের ধরনও অনেকটা বদলেছে। এ সময় অপরাধের সঙ্গে নতুন মাত্রা দিয়েছে প্রযুক্তি। শিশু-কিশোররা অনলাইন ঘেঁটে শুধু শিক্ষামূলক কনটেন্টই দেখছে এমন নয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে যায় না এমন অনেক অনৈতিক কনটেন্টও সার্চ করছে। নিজেদের জীবনেও তার প্রয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ইমোর বিভিন্ন গ্রুপে পরিকল্পনা হয় গ্যাং কালচারের। কোথায় কখন আড্ডা হবে, কতগুলো বাইক/গাড়ি থাকবে, কোন এলাকায় অবস্থান নিতে হবে, এমনকি কোথায় বসে কোন ধরনের মাদক গ্রহণ করবে, তা-ও ঠিক করে ফেলছে ঘরে বসে এসব গ্রুপে। অভিভাবক এবং আইন প্রয়োগাকারী সংস্থার সদস্যরাও টের পান না তাদের এসব পরিকল্পনার। সম্প্রতি শিশু-কিশোরদের ওপর একটি সমীক্ষা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা স্মার্টফোনকেন্দ্রিক ইন্টারনেটের সুযোগকে অপব্যবহার করছে। তাই অন্তত এইচএসসি পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের কাছে স্মার্টফোন না দেয়ার পরামর্শ অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদের। জানতে চাইলে ডিএমপির সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এডিসি মোঃ নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রযুক্তি অপরাধ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ ছাড়া সিআইডি ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দেশের ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট যেভাবে হচ্ছে, প্রযুক্তির অপরাধগুলোও সেভাবে আসছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। পাশাপাশি কেউ অভিযোগ করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ ডিএমপির সাইবার সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা গেছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি আইন, আইসিটি আইন টেলিকমিউনিকেশন এ্যাক্ট আইনে সারাদেশে ২০১৫ সালে ৬৩৮টি, ২০১৬ সালে ৯২৩টি, ২০১৭ সালে ১০৪৫টি, ২০১৮ সালে ১১৬৫টি, ২০১৯ সালে ১৫০৭টি এবং ২০২০ সালে ১৪৫৯টি মামলা হয়। প্রযুক্তি অপব্যবহার ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় এই মামলাগুলোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাইবার বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর জোহা খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককেন্দ্রিক অপরাধ যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, সেখানে ফেসবুকের ‘এডিটিং প্যানেল’ বাংলাদেশে নিয়ে আসা খুবই জরুরী। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ফেসবুক এডিটিং প্যানেল রয়েছে। তিনি বলেন, বিটিআরসির উচিত হবে তাদেরই তৈরি ‘প্যারেন্টাল গাইড লাইন’ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া। এতে শিশু ও কিশোররা প্রযুক্তির অপব্যবহার করতে একটু ভয় পাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্ট সুবিধা’ প্রদান সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। পরিচালক (লাইসেন্সিং) এম এ তালেব হোসেন স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান, আইএসপি (বিটিসিএল), আইপিটিএসপি, সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর, বিডব্লিউএ প্রতিষ্ঠানকে এ সংক্রান্তে ৮টি সুবিধা সংবলিত ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স সুবিধা’ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিতকরণের জন্য সরকার নির্দেশনা দিয়েছে। ওই দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এ সংক্রান্তে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা কমিশনের এলএল বিভাগে অবহিত করার নির্দেশনা দেয়া হলো। অন্যথায় ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমিশন অপারেশন কার্যক্রম বন্ধসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তথা ব্যক্তির সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল আইনের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের বিষয়ে জোরালো আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জুয়া ও পর্নোসহ ক্ষতিকর ওয়েবসাইট বন্ধ করতে সরকার সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে তিনি দাবি করেন। অবাধ যৌনাচার ও প্রতারণার ফাঁদ ‘বিগো লাইভ’ ও ‘স্ট্রিমকার’ ॥ লাইভ স্ট্রিমিং এ্যাপ ‘স্ট্রিমকার’। এই এ্যাপসে গ্রুপ চ্যাট, লিপ সিং, ড্যান্স, গল্প, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন জুয়া খেলার অপশন রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের এই এ্যাপটিতে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি হচ্ছে ইউজার আইডি এবং একটি হোস্ট আইডি। ইউজাররা সাধারণত সুন্দরী মেয়েদের ও সেলিব্রেটিদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার জন্য এই এ্যাপটি ব্যবহার করে আর হোস্টররা একটি হোস্ট এজেন্সির মাধ্যমে এই এ্যাপে হোস্টিং করেন। সুন্দরী মেয়ে এবং সেলিব্রেটিরাই সাধারণত এই এজেন্সির মাধ্যমে হোস্ট আইডি খোলেন। এতে দুই ধরনের এজেন্সি রয়েছে- ‘বিন্স এজেন্সি’ ও ‘হোস্ট এজেন্সি’। বিন্স এজেন্সিগুলো বিদেশী এ্যাপটির এ্যাডমিনদের কাছ থেকে বিন্স ক্রয় করে ইউজারদের কাছে বিক্রি করে। এই এ্যাপের ইউজাররা এই বিন্স, হোস্টদের সঙ্গে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য গিফট হিসেবে প্রদান করেন। বিন্স এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি। দুই ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি রয়েছে- ‘বিন্স’ ও ‘জেমস’। প্রতি এক লাখ বিন্সের মূল্য এক হাজার আশি টাকা এবং প্রতি লাখ জেমসের মূল্য ৬০০ টাকা। কিন্তু এক বিন্স সমান এক জেমস। ইউজাররা হোস্টদের গিফট হিসেবে বিন্স দেন কিন্তু এই বিন্স হোস্টদের কাছে এলেই তা জেমসে পরিণত হয়। সঞ্চিত জেমসের পরিমাণের ওপরই নির্ভর করে হোস্টদের ইনকাম। তবে হোস্টদের মাস শেষে বেতন পাওয়ার জন্য শুধু সঞ্চিত জেমস যথেষ্ট নয়। তাকে প্রতিদিন এবং প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লাইভ স্ট্রিমিংয়ে থাকতে হয়। লাইভ স্ট্রিমিং এ্যাপ ‘স্ট্রিমকার’র মতোই ‘বিগো লাইভ’ এ্যাপসটি। এর মাধ্যমে তরুণ ও যুবকদের টার্গেট করে লাইভে এসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দিয়ে এবং যৌনতার ফাঁদে ফেলে কৌশলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। রবিবার লাইকি-বিগো পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মোস্তাফা সাইফ রেজা (২৬), মোঃ আরিফ হোসেন (২৭), এস এম নাজমুল হক (২৭), আসমা উল হুসনা সেজুতী (২৮) এবং অজ্ঞাত এক বিদেশী নাগরিক। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, প্রাইভেটকার, বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে মালিবাগ সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সিআইডি সাইবার পুলিশের প্রধান ডিআইজি জামিল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেফতার বিদেশী নাগরিক বিগো লাইভ ও লাইকির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশী নাগরিক মোস্তফা সাইফ রেজা বিগো-লাইকির বাংলাদেশী এ্যাডমিন। গ্রেফতার আরিফ হোসেন বাংলাদেশে বিভিন্ন মেয়েদের মাসিক বেতনে চাকরি দিয়ে বিগো লাইভের সঙ্গে যুক্ত করতেন। এস এম নাজমুল হক ভার্চুয়াল মুদ্রা ডায়মন্ড বিক্রির অন্যতম প্রধান বাংলাদেশী এজেন্ট এবং আসমা উল হুসনা সেজুতী বিগো লাইভের প্রধান এ্যাডমিন। এ্যাডমিনরা মাসে এক লাখ টাকা করে বেতন পেতেন। ডিআইজি জামিল আহমেদ বলেন, লাইভ স্ট্রিমিং এ্যাপ বিগো লাইভ ও লাইকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়টি সিআইডির সাইবার পুলিশের নজরে আসে। সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধের তথ্য প্রকাশ হয়। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডির সাইবার পুলিশ অনুসন্ধান শুরু করে। তিনি বলেন, অনুসন্ধানে জানা যায় বিগো লাইভ ও লাইকিতে সাধারণত দেশের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা ভিডিও স্ট্রিমিং করে। বিগো লাইভ এ্যাপে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি ব্রডকাস্টার আইডি ও অন্যটি সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডি। ব্রডকাস্টার আইডি ব্যবহার করে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা ভিডিও লাইভ স্ট্রিম করে। এই ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে কথিত বিনোদনের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া হয়। সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডির মাধ্যমে যারা ভিডিও স্ট্রিমিং করত, তাদের ডিজিটাল কয়েন সদৃশ ডায়মন্ড গিফট করা হতো। সিআইডি বলছে, এসব এ্যাপে ভিডিও স্ট্রিমিং লাইভ চ্যাট ও ফিসিং গেমের অপশন রয়েছে। এসব ব্যবহারে প্রয়োজন হয় ‘ডায়মন্ড’ নামে এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি। এ্যাপস ব্যবহারকারী লাখ লাখ বাংলাদেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা মোবাইল এবং ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডায়মন্ড কিনছেন। বাংলাদেশী বিভিন্ন এজেন্সি ডায়মন্ড কিনে আনে বিদেশী এ্যাডমিনদের কাছ থেকে। এসব এজেন্সি বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিগো লাইভ এ্যাপের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অর্থ পাচার করেছে বিভিন্ন চক্র। এই এ্যাপের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান এ্যাপটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সাইবার পুলিশের ডিআইজি জামিল আহমেদ বলেন, ডায়মন্ড সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে পৌঁছে দিত বিভিন্ন এজেন্সি। এরকম একাধিক এজেন্সি বাংলাদেশে রয়েছে। এসব এজেন্সির প্রত্যেকের একাধিক পেমেন্ট গেটওয়ে রয়েছে। সাধারণত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব এজেন্সির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এজেন্সির পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে ডায়মন্ড কেনেন। তিনি বলেন, এ্যাপ ব্যবহারকারী লাখ লাখ বাংলাদেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনলাইন ব্যাংকিং, হুন্ডি, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও ব্যাংকের মাধ্যমে ডায়মন্ড কিনছেন। বাংলাদেশী এজেন্সিগুলো ডায়মন্ড কিনে আনে বিদেশী এ্যাডমিনদের কাছ থেকে। এসব এজেন্সি বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে মাসেই বিদেশে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেকের নাম এসেছে এবং তাদের বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের এ্যাকাউন্টে গত এক বছরে প্রায় শত কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। ডায়মন্ড কিভাবে ক্রয় করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি জামিল আহমেদ বলেন, বিগো লাইভ থেকে মেসেজ দিয়ে অথবা হোয়াটসএ্যাপে যোগাযোগ করে ডায়মন্ড কেনা সম্ভব। গ্রেফতার এস এম নাজমুল হক মূলত বিদেশী এজেন্সির মাধ্যমে ডায়মন্ড কেনাবেচা করতেন। এসব এ্যাপ বন্ধের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ সিআইডি নেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লাইকি ও বিগো লাইভ এ্যাপ বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমরা নিয়ন্ত্রণকারীদের এসব বিষয় নজরে আনব। এছাড়াও আমরা এসব এ্যাপ সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি। যারা অশ্লীল ভিডিও দিচ্ছেন তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এসব এ্যাপের অফিস আমাদের দেশে খোলার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের স্বার্থে আপাতত ব্যাংকগুলোর নাম বলছি না। তবে কোন কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা লেনদেন হয়েছে তা আমরা তদন্ত করছি। অনলাইনে মাদক বেচাকেনা ॥ গত ২৬ মে রাজধানীর ধানম-ি ও লালমাটিয়া থেকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাদমান সাকিব ওরফে রুপল ও আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তূর্য এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিন আশরাফকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা ফেসবুক আইডি ও মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর এলএসডি সেবন ও বিক্রির সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল। তাদের ফেসবুক আইডির নাম ‘আপনার আব্বা’। আর মেসেঞ্জার গ্রুপের নাম ‘বেটার ব্রাউনি এ্যান্ড বেয়ন্ড’। এই গ্রুপের ১ হাজার সদস্য রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান তাদের কাছ থেকে এলএসডি সংগ্রহ করে ঈদের পরদিন ১৫ মে ক্যাম্পাসের কার্জন হলে বসেই সেবন করে বলে তথ্য মিলেছে। পরে ডাব বিক্রেতার দা নিয়ে নিজের গলায় আঘাত করে মারা যায় হাফিজ। এক বছর ধরে রুপল গ্রুপ নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি সংগ্রহ করে বিক্রি করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, ব্যাংকারসহ প্রতিষ্ঠিত পরিবারের কিছু সন্তান তাদের চক্রে জড়িত বলে জানা গেছে। এছাড়া গত বছরের মে মাসে ‘ওয়েড লাভারস’ বা ‘গাঞ্জাপ্রেমী’ নামে একটি ফেসবুক আইডির সন্ধান পায় র‌্যাব-২ এর সদস্যরা। ওই গ্রুপে ১৫ হাজার সদস্য রয়েছে। এই গ্রুপের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রুপে প্রকাশ্যে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রির প্রচার চালানো হচ্ছিল। গ্রুপের মাধ্যমেই মাদক কেনাবেচা করত সংঘবদ্ধ চক্রটি। কোথায় কিভাবে মাদক পাওয়া যাবে এবং এর হোম ডেলিভারি কিভাবে হবে তার বিস্তারিত সেখানে বলা হয়। এরপর মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে মাদক মোটরসাইকেলের মাধ্যমে পৌঁছে দেয় ওই সিন্ডিকেট। আর মাদকের টাকা নেয়া হয় অনলাইন ব্যাকিংয়ের মাধ্যমে। টিকটক-লাইকি এ্যাপে বিপথগামী তরুণ প্রজন্ম ॥ সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভারতে এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশী যুবকের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণী ও অভিযুক্ত সবাই রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ গ্যাং গ্রুপের সদস্য। ভারতীয় পুলিশ তাদের গ্রেফতার এবং ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, প্রায় ২০-২২ বছর বয়সী একটি মেয়েকে বিবস্ত্র করে ৩/৪ যুবক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের কেরলে। পরে টিকটক হৃদয় সেই ভিডিও ভারতের বিভিন্ন বন্ধুদের কাছে শেয়ার করেন। এরপর সেই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পুলিশ বলছে, এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করত। একই সঙ্গে বিদেশে মানব পাচারেও এরা জড়িত। গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে ইংরেজী মাধ্যম স্কুল মাস্টারমাইন্ডের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিন ওরফে শাহনূরী হত্যাকা- সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। তদন্তে উঠে আসে, গ্রেফতার ইফতেখার ফারদিন দিহান ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি দেখে সেক্স ফ্যান্টাসিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। আনুশকার সঙ্গে বিপজ্জনক বিকৃত যৌনাচারে ফরেন বডি বা সেক্স টয় ব্যবহার করে সে। ‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেমে ভয়ঙ্কর আসক্তি কিশোর-কিশোরীদের ॥ গেরিনা ফ্রি ফায়ার (ফ্রি ফায়ার ব্যাটলগ্রাউন্ডস বা ফ্রি ফায়ার নামেও পরিচিত) একটি ব্যাটল রয়্যাল গেম। ২০১৯ সালে এটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ডাউনলোড করা মোবাইল গেম। গেমটি অন্য খেলোয়াড়কে হত্যা করার জন্য অস্ত্র এবং সরঞ্জামের সন্ধানে একটি দ্বীপে প্যারাসুট থেকে পড়ে আসা ৫০ জন ও তার অধিক খেলোয়াড়কে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বন্দুক দিয়ে মসজিদে মুসলমানদের হত্যা এবং সেই দৃশ্য ফেসবুক লাইভের বিষয়টি অনেকেই পাবজির সঙ্গে তুলনা করেন। সম্প্রতি নেপালে পাবজি নিষিদ্ধ করে দেশটির আদালত। একই কারণে ভারতের গুজরাটেও এ গেম খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। এমনকি গেমটি খেলার জন্য কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। অনলাইন গেম ‘প্লেয়ার আননোনস ব্যাটলগ্রাউন্ডস’ (পাবজি)। সমাজের নেতিবাচক প্রভাব ও শিক্ষার্থী-কিশোর-কিশোরীদের সহিংস করে তুলছে এমন আশঙ্কা থেকেই গেমটি বন্ধ করা উচিত বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। পাবজি গেমটির মোবাইল ভার্সনে একসঙ্গে অনেকজন মিলে অবতরণ হন এক যুদ্ধক্ষেত্রে। যতক্ষণ না পর্যন্ত একজন সিঙ্গেল সেনা বেঁচে থাকছেন যুদ্ধে ততক্ষণ খেলে যেতে হয়। ২০১৮ সালে এ্যাঙ্গরি বার্ড, টেম্পল রান, ক্যান্ডি ক্রাশের মতো গেমগুলোকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন গেমের তালিকায় শীর্ষে জায়গা করে নেয় পাবজি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে দেশে জনপ্রিয় তরুণ প্রজন্মের মাঝে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি। দক্ষিণ কোরিয়ার গেম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ব্লু হোয়েলের অনলাইন ভিডিও ২০১৭ সালে চালু হয়। এরপর থেকে এই গেমটি দ্রুত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে চায়না প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে তৈরি করা যুদ্ধ গেম ফ্রি ফায়ার একইভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই গেম দুটির ব্যবহারের ফলে দিনে দিনে এর অপব্যবহারের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এর ফলে তরুণ প্রজন্ম যাকে কিশোর গ্যাং বলা হয়। এরা চরমভাবে বিপথগামী হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে করোনা মহামারীর ফলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে অন্যদিকে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস হওয়ার ফলে অভিভাবকরা তার সন্তানদের হাতে সহসাই ল্যাপটপ, মোবাইল ডিভাইস তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ সুযোগের বেশির ভাগ অপব্যবহার ঘটছে। এমনকি তরুণ প্রজন্ম এই গেম দুটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। ‘তিন পাত্তি গোল্ড’সহ বিভিন্ন অনলাইনে জুয়া খেলে হুন্ডিতে অর্থ লেনদেন ॥ সারাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেক বাংলাদেশী ‘তিন পাত্তি গোল্ড’সহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়া গেম খেলছেন এবং তাদের গেমিং এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) মাল্টার একটি অনলাইন গেমিং প্রতিষ্ঠানে ২০ বাংলাদেশীর নিবন্ধিত এ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছেন। তারা গত অর্থবছরে এ্যাকাউন্টে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা জমা করেছেন এবং প্রায় ২২ কোটি টাকা তুলেছেন। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০১৯-২০’র বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থের উৎসের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব ও প্রচুর অর্থ সরবরাহের কারণে ২০ বাংলাদেশীর এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে গেমিং কোম্পানিগুলো। অনলাইন জুয়া খেলা ও অর্থ পাচারের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল আর্থিক পরিষেবাও ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানতে পেরেছে বিএফআইইউ। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি তিন পাত্তি গোল্ড গেমটি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অনলাইনে গেমটি ‘চিপ’ (তিন পাত্তি জুয়ার ভার্চুয়াল কয়েন) ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ করছেন। মূলত মোবাইল আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমেই এ ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে এর বিপণন হয়।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!