ছয় দফা আন্দোলন

Joynal Abdin
0

ছয় দফা আন্দোলন





ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ২৩ মার্চ।





ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেলরাষ্ট্র ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ফেডারেলরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ন স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়।বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালির মুক্তির সনদও বলা হয়।





প্রতি বছর ৭ই জুন বাংলাদেশে '৬ দফা দিবস' পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন।





ইতিহাস





ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ রপ্তানি (যেমন পাট) হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এর ফলে, অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা বৈষম্য সম্পর্কে প্রশ্ন বাড়াতে শুরু করে এবং ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রদান করে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া হলঃ





বছরপশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় (কোটি রুপি)পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় (মোট শতাংশ)পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় (কোটি রুপি)পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় (মোট শতাংশ)
% জনসংখ্যা৩৬.২৩৬৩.৭৭
১৯৫০-৫৫,১২৯৬৮.৩১৫২৪৩১.৬৯
১৯৫৫-৬০,৬৫৫৭৫.৯৫৫২৪২৪.০৫
১৯৬০-৬৫,৩৫৫৭০.,৪০৪২৯.৫০
১৯৬৫-৭০,১৯৫৭০.৮২,১৪১২৯.১৮
মোট১১,৩৩৪৭১.১৬,৫৯৩২৮.৮৪




বাঙালির মুক্তির সনদ-দফা









1





বাঙালি জাতি চির দুর্বার, চির দুর্মর। যুগে যুগে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। শক্তিবলে অসম হলেও তারা ব্রিটিশদের সামনেও কভু মাথা নত করেনি। পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর দুঃশাসন,অত্যাচারে জর্জরিত বাঙালি দৃঢ়কন্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছে। ৫২’র হার না মানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার । ধীরে ধীরে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেছে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে।





এ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলার মাটিকে চিরতরে স্বাধীন করার বীজ বপন করা হয় ১৯৬৬ সালের ছয় দফার দাবীর মধ্যে দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবী বাঙালী জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের ভিত্তিস্তম্ভ স্বরূপ। ছয় দফা বাঙালীর “মুক্তির সনদ”। বহুকাল থেকে অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার বাঙালী জাতি “ছয় দফা দাবী” প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে নতুন দিক নির্দেশনা পেয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগের ওয়াকিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। এর পর ১৮ মার্চ আওয়ামীলীগের ওয়াকিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমেদের বিশ্লেষণ সহ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এর পর ১৮ মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবিঃ ছয় দফা কর্মসূচী” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ‘৬ দফা কর্মসূচীর’ প্রচারণায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা পরিদর্শন করেন।





শাসক গোষ্ঠী তাকে রুখতে না পেরে বাধ্য হয়ে ছয় দফা প্রচার কালে ১৯৬৬ সালের ৯মে গ্রেফতার করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার বীর বাঙালীকে দামাতে পারেননি। ৬ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবীতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৭ জুন তাই ‘ছয় দফা দিবস’।





বঙ্গবন্ধু ছয় দফায় বলেছিলেন,





আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,





                    আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ হৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব পাক জনগণের মুক্তি সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প ব্যয় শিক্ষা লাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।





আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবিতেও এঁরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি – তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬-দফা দাবী অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬-দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থ শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।





কিন্তু এও আমি জানি জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এঁদের অফুরন্ত, মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারী দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশ্মনির বেলায় এঁরা সকলে একজোট। এরা নানা ছলা-কলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হইবেন না তাতেও আমার কোন সন্দেহ নাই। তথাপি ৬-দফা দাবীর তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী বিশেষতঃ আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি, তাঁরা সকলে অবিলম্বে ৬-দফার ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়াইয়া পড়িবেন। কর্মী ভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ৬-দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ারী সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরও পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি, সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানী মাত্রেই এই সব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।





১নং দফা





এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পালামেন্টরী পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।





ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়াছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি। মুসলিম লীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকারী সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তাঁরা এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করিয়াছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হইবে, এ সব যুক্তি তখন দেয়া হইয়াছিল। তথাপি পূর্ব বাংলার ভোটাররা এই প্রস্তাবসহ একুশ দফার পক্ষে ভোট দিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চুড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়াই গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনও নতুন দাবি তুলি নাই। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরান দাবীরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁতকাইয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান সংগ্রামে শরিক র্ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমী স্বার্থীদের দালালি করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।





এই দফায় পার্লামেন্টরী পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটে সরাসারি নির্বাচন ও আইন সভার সার্বভৌমত্বের যে দাবী করা হইয়াছে তাতে আপত্তির কারণ কি? আমার প্রস্তাবই ভাল, না প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতাহীন আইন সভাই ভাল, এ বিচারভার জনগণের উপর ছাড়িয়া দেয়াই কি উচিত নয়? তবে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতির এই তরফদারেরা এই সব প্রশ্নে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনমত যাচাই এর প্রস্তাব না দিয়া আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করিতেছেন কেন? তাঁরা যদি নিজেদের মতে এতই আস্থাবান, হবে আসুন এই প্রশ্নের উপরই গণভোট হইয়া যাক।





২নং দফা





এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে।






এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমর উপর সর্বাপেক্ষা বেশী চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ইহাদের এতই অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। ইহারা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, বৃটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে ‘প্ল্যান’ দিয়াছিলেন এবং যে ‘প্ল্যান’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এই তিনটি মাত্র বিষয় ছিল এবং বাকী সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেয়া হইয়াছিল। ইহা হইতে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, বৃটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এই যে, এই তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে। অন্য কারণে কংগ্রেস চুক্তি ভঙ্গ করায় ক্যাবিনেট প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। তা না হইলে এই তিন বিষয় লইয়াই আজও ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে থাকিত। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যাবিনেট প্ল্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়াছি সত্য, কিন্তু তার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। অখণ্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখণ্ডতা ছিল। ফেডারেশন গঠনের রাষ্ট্র বৈজ্ঞানিক মূলনীতি এই যে, যে যে বিষয়ে ফেডারেটিং স্টেটসমূহের স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য, কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশনের এখতিয়ারে দেয়া হয়। এই মূলনীতি অনুসারে অখণ্ড ভরতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিল। পেশাওয়ার হইতে চাটগাঁ পর্যন্ত একই রেল চলিতে পারিত। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য তো নয়ই, বরঞ্চ সম্পূর্ণ পৃথক। রেলওয়েকে প্রাদেশিক সরকারের হতে ট্রান্সফার করিয়া বর্তমান সরকারও তা স্বীকার করিয়াছেন। টেলিফোন টেলিগ্রাফ পোষ্ট অফিসের ব্যাপারেও এ সত্য স্বীকার করিতেই হইবে।





তবে বলা যাইতে পারে যে, একুশ দফায় যখন কেন্দ্রকে তিনটি বিষয় দিবার সুপারিশ ছিল, তখন আমি আবার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুইটি বিষয় দিলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমি ৩নং দফার ব্যাখ্যায় দিয়াছি। এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না।





আরেকটা ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে। আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলিয়া স্টেট বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থ শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ বুঝাইয়াছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস্’ বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ‘ফেডারেশন’ অথবা ‘ইউনিয়ন’ বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানী, এমন কি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ‘ইউনিয়ন’ বা ‘ফেডারেশন’ বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয়; ‘স্টেট’। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেইবা কর্তারা এত এলার্জিক কেন?





৩নং দফা





এই দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অল্টারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এই দুইটি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণ করিলেই চলিবেঃ





ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পুর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট’ ব্যাংক থাকিবে।









বাঙালির মুক্তির সনদ ‘৬-দফা’




খ. দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সী থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।





হইতে প্রদেশের হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় অল্টারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। ঐ অবস্থায় আমি একুশ দফা প্রস্তাবের খেলাফে কোনও সুপারিশ করিয়াছি, একথা বলা চলে না।





যদি পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু প্রথম বিকল্প অর্থ্যাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইলে আমাদের এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই প্রস্তাবে রাজী হইবেন। আমরা তাঁদের খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ত্যাগ করিয়া সংখ্যা-সাম্য মানিয়া লইয়াছি, তারা কি আমাদের খাতিরে এইটুকু করিবেন না?
আর যদি অবস্থাগতিকে মুদ্রাকে প্রদেশের এলাকায় আনিতেও হয়, তবু তাতে কেন্দ্র দুর্বল হইবে না; পাকিস্তানের কোনও অনিষ্ঠ হইবে না। ক্যাবিনেট প্ল্যানে নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল, তাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। ঐ প্রস্তাব পেশ করিয়া বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চলিতে পারে। কথাটা সত্য। রাষ্ট্রীয় অর্থ বিজ্ঞানে এই ব্যবস্থার স্বীকৃতি আছে। কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অর্থনীতি রাখা এবং একই দেশে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকার নজির দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রেও আছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাংকের দ্বারা। এতে যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস হয় নাই; তাদের আর্থিক বুনিয়াদও ভাঙ্গিয়া পড়ে নাই। অতো যে শক্তিশালী দোর্দ- প্রতাপ সোভিয়েট ইউনিয়ন, তাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোন অর্থমন্ত্রী বা অর্থদফতর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থ্যাৎ স্টেট রিপাবলিক সমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থদফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐ সব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রীর দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশেও আঞ্চলিক সুবিধার খাতিরে দুইটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাংক বহুদিন আগে হইতেই চালু আছে।





আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরোক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকিবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লেখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘লাহোর’ লেখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্পও গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শন স্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহয়োগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে।





একটু তালাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে, এই দুই ব্যবস্থার একটি গ্রহণ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার কোন উপায় নাই। সারা পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা হওয়ায় ও দুই অঞ্চলের মুদ্রার মধ্যে কোন পৃথক চিহ্ন না থাকায় আঞ্চলিক কারেন্সী সার্কুলেশনে কোন বিধি নিষেধ ও নির্ভুল হিসাব নাই। মুদ্রা ও অর্থনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে। সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, ইনসিওরেন্স ও বৈদেশিক মিশনসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় প্রতি মিনিটে এই পাচারের কাজ অবিরাম গতিতে চলিতেছে। সকলেই জানেন সরকারী স্টেট্ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ সমস্ত ব্যাংকের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। এই সেদিন মাত্র প্রতিষ্ঠিত ছোট দু-খানি ব্যাংক ইহার সাম্প্রতিক ব্যতিক্রম মাত্র। এই সব ব্যাংকের ডিপোজিটের টাকা, শেয়ার মানি, সিকিউরিটি মানি, শিল্প-বাণিজ্যের আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি, এক কথায় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সমস্ত আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢালা পানির মত একটানে তলদেশে হেড অফিসে অর্থ্যাৎ পশ্চিম পাকিস্তনে চলিয়া যাইতেছে, পূর্ব পাকিস্তান শুকাইয়া বালুচর হইয়া যাইতেছে। বালুচরে পানির দরকার হইলে টিউবওয়েল খুদিয়া তলদেশ হইতে পানি তুলিতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের টিউবওয়েলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আনিতে হয়। উদ্বৃত্ত আর্থিক সেভিং তলদেশেই অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেই জমা থাকে। এই কারনেই পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাপিটেল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। সব ক্যাপিটেল ফর্মেশন পশ্চিমে হইয়াছে। বর্তমান ব্যবস্থা চলিতে থাকিলে কোন দিন পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গঠন হইবেও না। কারণ সেভিং মানেই ক্যাপিটেল ফর্মেশন।





শুধু ফ্লাইট-অব-ক্যাপিটেল বা মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতি হেতু পূর্ব পাকিস্তানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দুর্মুল্যতা, জনগণের বিশেষতঃ পাট চাষীদের দুর্দশা সমস্তের জন্য দায়ী এই মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি ৫ নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রখিতেছি যে, এই ফ্লাইট অব ক্যাটিটেল বন্ধ করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজেরা শিল্প বাণিজ্যে এক পা-ও অগ্রসর হইতে পারিবে না। কারণ এ অবস্থায় মূলধন গড়িয়া উঠিতে পারে না।





৪নং দফা





এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধায্য ও আদায়ের ক্ষমতা থকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিকক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।





আমার এই প্রস্তাবেই কায়েমী স্বার্থের কালোবাজারী ও মুনাফাখোর শোষকরা সবচেয়ে বেশী চমকিয়া উঠিয়াছে। তারা বলিতেছে, ট্যাক্স ধার্য্যরে ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের না থাকিলে সে সরকার চলিবে কিরূপে? কেন্দ্রীয় সরকার তাতে যে একেবারে খয়রাতী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে। খয়রাতের উপর নির্ভর করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার দেশরক্ষা করিবেন কেমনে? পররাষ্ট্র নীতিই বা চালাইবেন কি দিয়া? প্রয়োজনের সময় চাঁদা না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তো অনাহারে মারা যাইবেন। অতএব এটা নিশ্চয়ই পাকিস্তান ধ্বংসেরই ষড়যন্ত্র।





কায়েমী স্বার্থীরা এই ধরনের কত কথাই না বলিতেছেন। অথচ এর একটা আশঙ্কাও সত্য নয়। সত্য যে নয় সেটা বুঝিবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি তাঁদের নিশ্চয়ই আছে। তবু যে তাঁরা এসব কথা বলিতেছেন, তাঁরা একমাত্র কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত স্বার্থ। সে স্বার্থ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবাধে শোষণ ও লুণ্ঠন করার অধিকার। তাঁরা জানেন যে, আমার এই প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্য্যরে দায়িত্ব দেয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মত যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সে ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। এটাই সরকারী তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তারা এটাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্য্যরে ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্বীকৃত। তাঁরা এ খবরও রাখেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান বৃটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্য্যরে ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেয়া হইয়াছিল; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেয়া হয় নাই। ৩ নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থদফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েট ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থদফতর বলিয়া কোন বস্তুর অস্তিত্বই নাই। তাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া পড়িয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনী ও পররাষ্ট্র দফতর কি সে জন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তানের দেশরক্ষা ব্যাবস্থা দুর্বল হইবে না। কারণ আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রের এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই যে টাকা ট্যাক্স ধার্য্য ও আয় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সে টাকায় হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে। সে টাকার আঞ্চলিক সরকারের কোন হাত থাকিবে না। এই ব্যবস্থায় অনেক সুবিধা হইবে। প্রথমত: কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স আদায়ের ঝামেলা পোহাইতে হইবে না। দ্বিতীয়ত: ট্যাক্স ধার্য্য ও আদয়ের জন্য কোন দফতর বা অফিসার বাহিনী রাখিতে হইবে না। তৃতীয়ত: অঞ্চলে ও কেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স ধার্য্য ও আদায়ের মধ্যে ডুপ্লিকেশন হইবে না তাতে আদায়ী খরচায় অপব্যয় ও অপচয় বন্ধ হইবে। ঐভাবে সঞ্চিত টাকার দ্বারা গঠন ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করা যাইবে। অফিসার বাহিনীকেও উন্নততর সৎকাজে নিয়োজিত করা যাইবে। চতুর্থত: ট্যাক্স ধার্য্য ও আদায়ের একীকরণ সহজতর হইবে। সকলেই জানেন, অর্থ বিজ্ঞানীরা এখন ক্রমেই সিংগল ট্যাক্সেশনের দিকে আকৃষ্ট হইতেছেন। সিংগল ট্যাক্সেশনের নীতিকে সকলেই অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসু বলিয়া অভিহিত করিতেছেন। ট্যাক্সেশনকে ফেডারেশনের এলাকা হইতে অঞ্চলের এখতিয়ার ভুক্ত করা এই সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আর্থিক নীতি গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে।





৫নং দফা





এই দফায় আমি বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নি¤œরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছিঃ





১। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।
২। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে।
৩। ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।
৪। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী রফতানী চলিবে।
৫। ব্যবসা বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।





পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই ব্যবস্থা ৩নং দফার মতই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের আঠার বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলাইলেই দেখা যাইবে যে-





ক) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্পজাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা বলা হইতেছে।
খ) পূর্ব পাকিস্তানে মুলধন গড়িয়া না উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নাই এই অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিদেশী আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।
গ) পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণ ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিমাণ রফতানী করে আমদানী করে সাধারণতঃ তার অর্ধেকের কম। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মত লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম এত বেশী। বিদেশ হইতে আমদানী করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দামের তুলনা করিলেই এটা বুঝা যাইবে। বিদেশী মুদ্রা বণ্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকার ফলেই আমাদের এই দুর্দশা।
ঘ) পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাট চাষীকে পাটের ন্যায্য মুল্য তো দূরের কথা আবাদী খরচাটাও দেয়া হয় না। ফলে পাটচাষীদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারেন না। এমন অদ্ভুত অর্থনীতি দুনিয়ার আর কোন দেশে নাই। যত দিন পাট থাকে চাষীর ঘরে, তত দিন পাটের দাম থাকে পনর বিশ টাকা। ব্যবসায়ীর গুদামে চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথে তার দাম হয় পঞ্চাশ। এ খেলা গরীব পাট চাষী চিরকাল দেখিয়া আসিতেছে। পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ করিয়া পাট রফতানীকে সরকারী আয়ত্তে আনা ছাড়া এর কোন প্রতিকার নাই, একথা আমরা বহুবার বলিয়াছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন গঠন করিয়াছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে পুঁজিপতিরা আমাদের সে আরদ্ধ কাজ ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
ঙ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হইতেছে তা নয়, আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার জোরে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী লোন ও এইড আসিতেছে, তাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হইতেছে। কিন্তু সে লোনের সুদ বহন করিতে হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানকেই। ঐ অবস্থার প্রতিকার করিয়া পাট চাষীকে পাটের ন্যায্য মূল্য দিতে হইলে, আমদানী রফতানী সমান করিয়া জনসাধারণকে সস্তা দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করিয়া তাদের জীবন সুখময় করিতে হইলে এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পূর্ব পাকিস্তানীর হাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিতে হইলে আমার প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ান্তর নাই।





৬নং দফা





এই দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এ দাবী অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ দফার দাবিতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবি করিয়াছিলাম। তাতো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ইপিআর বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবি একুশ দফার দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বছরেও আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানীর বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি করিতে হইবে কেন? সরকার নিজে হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন্ মুখে? মাত্র সতর দিনের পাক-ভারত যুদ্ধই কি প্রমাণ করে নাই আমরা কত নিরুপায়? শত্রুর দয়া ও মর্জির উপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যতঃ আমদেরকে তাই করিয়া রাখিয়াছে।





তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আতœনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ দেশরক্ষা বাহিনী গঠন করুন। অস্ত্র কারখানা স্থাপন করুন। নৌ-বাহিনীর দফতর এখানে নিয়া আসুন। এ সব কাজ সরকার কবে করিবেন জানি না। কিন্তু ইতিমধ্যে অল্প খরচে ছোট খাট অস্ত্র শস্ত্র দিয়া আধা সামরিক বাহিনী গঠন করিতেও পশ্চিমা ভাইদের এত আপত্তি কেন? পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা উঠিলে তাও কেন্দ্রীয় রক্ষা তহবিলে নিয়া যাওয়া হয় কেন? ঐ সব প্রশ্নের উত্তর নাই। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে অঞ্চলের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরাও চাই না। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যেমন করিয়া পারে গরিবী হালেই আতœরক্ষার ব্যবস্থা করিবে, এমন দাবি কি অন্যায়? এই দাবি করিলেই সেটা হইবে দেশদ্রোহিতা?





এ প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই বোনদের খেদমতে আমার কয়েকটি আরজ আছে:





এক. তাঁরা মনে করিবেন না আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিকার দাবি করিতেছি। আমার ৬-দফা কর্মসূচীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দাবিও সমভাবেই রহিয়াছে। এ দাবি স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন।





দুই. আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তুপীকৃত হইতেছে তখন আমিও আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরাই দায়ী নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মত দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছেন। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না? কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে। এই আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ী আমাদের ভৌগলিক অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে অগ্রাহ্য করিয়া যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে সেই ব্যবস্থা। ধরুন, যদি পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া পূর্ব পাকিস্তানে হইত, তবে কার কি অসুবিধা সুবিধা হইত একটু বিচার করুন। পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২ টাকা খরচ হয় দেশরক্ষা বাহিনীতে এবং শতকরা বত্রিশ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায়। এই এখন শতকরা চুরানব্বই টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া তখন খরচ হইত পূর্ব পাকিস্তানে। আপনারা জানেন অর্থ বিজ্ঞানের কথা: সরকারী আয় জনগণের ব্যয় এবং সরকারী ব্যয় জনগণের আয়। এই নিয়মে বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের গোটা আয়ের অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় ঠিকই, কিন্তু সরকারী ব্যয়ের সবটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় সরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বিদেশী মিশনসমূহ তাদের সমস্ত ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানেই করিতে বাধ্য হইতেছেন। এই ব্যয়ের সাকুল্যই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। ফলে, প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান তার মোকাবেলায় ঐ পরিমাণ গরীব হইতেছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের রাজধানী হইত তবে এই সব খরচ পূর্ব পাকিস্তান হইত। আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা এই পরিমাণে ধনী হইতাম। আপনার পশ্চিম পাকিস্তানীরা ঐ পরিমাণে গরীব হইতেন। তখন আপনারা কি করিতেন? যে সব দাবি করার জন্য আমাকে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার তহ্মত দিতেছেন সেই সব দবি আপনারা নিজেরাই করিতেছেন। আমাদের চেয়ে জোরেই করিতেন। অনেক আগেই করিতেন। আমাদের মত আঠার বছর বসিয়া থাকিতেন না। সেটা করা আপনাদের অন্যায়ও হইত না।





তিন. আপনারা ঐসব দাবি করিলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা কি করিতাম, জানেন? আপনাদের সব দাবি মানিয়া লইতাম। আপনাদিগকে প্রাদেশিকতাবাদী বলিয়া গাল দিতাম না। কারণ, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, ও সব আপনাদের হক্ পাওনা। নিজের হক্ পাওনা দাবি করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। এ বিশ্বাস আমাদের এতই আন্তরিক যে, সে অবস্থা হইলে আপনাদের দাবি করিতে হইত না। আপনাদের দাবি করার আগেই আপনাদের হক্ আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতাম। আমরা নিজেদের হক্ দাবি করিতেছি বলিয়া আমাদের স্বার্থপর বলিতেছেন। কিন্তু আপনারা যে নিজেদের হক্রে সাথে সাথে আমাদের হকটাও খাইয়া ফেলিতেছেন, আপনাদের লোকে কি বলিবে? আমরা শুধু নিজেদের হকটাই চাই। আপনাদের হকটা আত্মসাৎ করিতে চাই না। আমাদের দিবার আওকাৎ থাকিলে বরঞ্চ পরকে কিছু দিয়াও দেই। দৃষ্টান্ত চান, শুনন তবে,





১। প্রথম গণ-পরিষদে আমাদের মেম্বর সংখ্যা ছিল ৪৪; আর আপনাদের ছিল ২৮। আমরা ইচ্ছা করিলে গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশরক্ষার সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে আনিতে পারিতাম। তা করি নাই।
২। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাই এর দরদ লইয়া আমাদের ৪৪টা আসনের মধ্যে ৬টাতে পূর্ব পাকিস্তানীর ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানী মেম্বর নির্বাচন করিয়াছিলাম।
৩। ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিতাম। তা না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষার দাবি করিয়াছিলাম।
৪। ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।
৫। আপনাদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্থলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির জন্য উভয় অঞ্চলে সকল বিষয়ে সমতা বিধানের আশ্বাস আমরা সংখ্যা গুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যা-সাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।





চার. সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই সাহেবান, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম। যদি পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইত তবে আপনাদের দাবি করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্যসত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম। দ্বিতীয় রাজধানীর নামে ধোকা দিতাম না। সে অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ব্যয় যাতে উভয় অঞ্চলে সমান হয়, তাতে নিখুঁত ব্যবস্থা করিতাম। সকল ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে এবং প্রদেশসমূহকে পৃথক পৃথকভাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতাম। আমরা দেখাইতাম, পূর্ব পাকিস্তানীরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের নয়, ছোট বড় নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানীর। পূর্ব পাকিস্তানীদের হাতেই দিতাম। আপনাদের কটন বোর্ডে আমরা চেয়ারম্যান হইতে যাইতাম না। আপনাদের প্রদেশের আমরা গর্ভনর হইতেও চাহিতাম না। আপনাদের পি.আই.ডি.সি, আপনাদের ওয়াপদ, আপনাদের ডি.আই.টি, আপনাদের পোর্ট ট্রাস্ট, আপনাদের রেলওয়ে ইত্যাদির চেয়ারম্যানি আমরা দখল করিতাম না। আপনাদেরই করিতে দিতাম। সমস্ত অল্ পাকিস্তানী প্রতিষ্ঠানকে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করিতাম না। ফলতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই মারাত্মক ডিস্প্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।





এমনি উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফ বোধই পাকিস্তানী দেশপ্রেশের বুনিয়াদ। এটা যার মধ্যে আছে কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এই প্রেম আছে, কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উপর নেতৃত্বের যোগ্য। যে নেতা বিশ্বাস করেন, দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা, দুই পাটি দাঁত, দুই হাত, দুই পা; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এই সব জোড়ার দুইটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে; যে নেতা বিশ্বাস করেন ইচ্ছা করিয়া বা জনিয়া শুনিয়া যারা পাকিস্তানের এক অঙ্গকে দুর্বল করিতে চায় তারা পাকিস্তানের দুশমন; যে নেতা দৃঢ় ও সবল হস্তে সেই দুশমনদের শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন, কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী। কেবল তাঁরই নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য অটুট এবং শক্তি অপরাজেয় হইবে। পাকিস্তানের মত বিশাল ও অসাধারণ রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের অন্তরও হইতে হইবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই মাপকাঠিতে আমার ছয়-দফা কর্মসূচীর বিচার করবেন। তা যদি তাঁরা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এই ছয়-দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি।





আজাদ পত্রিকায় গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ।     গণঅভ্যুত্থান





১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি। সেদিন ছিল হরতাল। এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান সরকার বিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় তীব্র এক গণঅভ্যূত্থানে





১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । ফলে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্র হয়।





পাকিস্তানি শাসকেরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে।





সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ চারজন।





এরপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিহাসে একে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই গণআন্দোলনকে।





'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব'





বর্তমান বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসু'র ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা ভিপি ছিলেন ।





সে সময়কার স্মৃতিচারণ করে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ১৯৬৯-এর সেই ঐতিহাসিক অগ্নিঝরা দিনগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল।"





"সময়টা ছিল এমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে তখন বন্দী। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনির মৃত্যুর দিন গুনছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেবেন।"





সে কারণে শেখ মুজিবকে ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটে আনার পর আবার গ্রেপ্তার করে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলার আসামী হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করা হয়। এই মামলার প্রকৃত নাম ছিল "রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান"।





তিনি বলেন, উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ করা ।





তবে পরের বছর জানুয়ারির চিত্র আমূল পাল্টে যায়। সেকথাই বলছিলেন মি.আহমেদ, "আমরা তখন আন্দোলন করেছি। কিন্তু ১৯৬৮ সালের ১৯শে এপ্রিল যখন বিচার শুরু হয় তখন আমরা ভাবতে শুরু করি যে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।"





"তখন প্রথম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং ডাকসুর ভিপি আমি, এবং জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করি এবং পরে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন-এর একটি অংশ এসে যোগ দেয়"।





৪ঠা জানুয়ারি এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১০জন ছাত্র নেতার সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন সংগঠিত করা হয়।





আসাদের মৃত্যু ও রক্তমাখা জামা নিয়ে শপথ





১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ঘোষণা দেয়া হয় ঊনসত্তরের ১৭ই জানুয়ারি। এর প্রতিবাদে ১৮ই জানুয়ারি কর্মসূচি দেয়া হয়। তোফায়েল আহমেদ জানাচ্ছেন যে হামলা চালানো হয়েছিল ওই কর্মসূচিতে।





প্রতিবাদে ২০শে জানুয়ারি মিছিল বের করা হলে গুলিতে মারা যান ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।





আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে পরদিন আবার কলাভবনে কর্মসূচি দেয়া হয়।





তোফায়েল আহমেদ জানান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে যোগ দেয়। বাদ পড়েননি শ্রমিকরাও।





আসাদের মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে বেগবান হয়ে ওঠে আন্দোলন।





ধারাবাহিকতায় আইয়ুব খান বাধ্য হন ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে।





মি. আহমেদ বলেন, "আসাদের গায়ের জামা দিয়ে পতাকা তৈরি করলাম। তার লাশ শহীদ মিনারে রেখে শপথ নিলাম, আসাদ তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।"





তিনি জানান, "মিছিল বের করা হলে সেনাবাহিনী বিউগলে জানায় 'ডেঞ্জার, ডেঞ্জার ... । কিন্তু পল্টনে দাঁড়িয়ে ২১ তারিখ হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়।"





"২১শে জানুয়ারি পল্টনে ২২ থেকে ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত পরবর্তী তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেদিন সেখানে মাওলানা ভাসানীও ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।"





তিনি জানান, "২২ তারিখ এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে কালো পতাকা ওঠেনি। ২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর হয় মশাল মিছিল। তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় যার শিরোনাম হয়েছিল 'স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল'।





এরপর ২৪শে জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত হন বলে জানান মি. আহমেদ।





"ঢাকা শহরের সমস্ত মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগুন জ্বলছে। মানুষের স্রোত পল্টনের দিকে। এই যে মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর - এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দিল।"





মাহ্‌বুব উল্লাহ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ২৪শে জানুয়ারির দিনটির স্মৃতিচারণ করে মাহ্‌বুব উল্লাহ বলেন, "১৯৬৮ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ৫ই ডিসেম্বর পরের দিন হরতালের ডাক দেন এবং তা পালিত হয়। সেখানে দু'জন নিহত হন।"





"পরদিন সাত তারিখেও হরতাল পালিত হয়। পরবর্তী ২৯শে ডিসেম্বর সারাদেশে হাট-হরতাল পালনের আহ্বান জানান মওলানা ভাসানী। এখান থেকে মানুষ আন্দোলনের উদ্দীপনা পায়।পরবর্তীতে ১১ দফা কর্মসূচি আসে ছাত্রসমাজ থেকে, যার মূল বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।"





মাহ্‌বুব উল্লাহ জানান, "এরপর ১৭ই জানুয়ারি থেকে আন্দোলনের সূচনা। ২০শে জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলেন। এরপর ২৪শে জানুয়ারি আরেকটি হরতালের ডাক দেয়া হয়।"





"সে ছিল এক বিশাল গণ-অভ্যুত্থান। যখন আমরা পল্টন ময়দানে জড়ো হলাম আমাদের সামনে পাঁচ লক্ষ লোকের বিশাল সমাবেশ। জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড আক্রোশ এবং ক্রোধ কাজ করছিল।"





"তারা তৎকালীন গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) হামলা করতে চাইছিল। কিন্তু এটা হবে হঠকারী এবং বহু মানুষের প্রাণ হারাবে সেই চিন্তা করে আমরা সেখানে শহীদ মতিউরের জানাযা আদায় করে মিছিল নিয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের দিকে চলে গেলাম," বলছিলেন মাহ্‌বুব উল্লাহ।





তিনি বলেন, "ছাত্র সমাজ, মেহনতি জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের একতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয় এই আন্দোলনকে ঘিরে।"





ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক জানান, "আন্দোলন তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।"





'মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি...'





তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২৪শে জানুয়ারি নিহত হওয়া নবকুমার ইন্সটিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান এর আগে পল্টনে গায়েবানা জানাযাতে অংশ নিয়েছিল। সেই মতিউরকে তার বাবা আন্দোলন থেকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।





মৃত কিশোর মতিউরের পকেটে হাত দিয়ে পরে একটি চিরকুট পাওয়া গেল, যেখানে লেখা ছিল - "মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি তাহলে মনে করো, তোমার মতিউর বাংলার মানুষের জন্য, শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল, ইতি মতিউর রহমান।"





আজকের বঙ্গভবন তখন পরিচিত ছিল গভর্নর হাউজ হিসেবে। সেখানেও আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল উত্তেজিত জনতা।





তোফায়েল আহমেদ বলেন, এরপর মিছিল নিয়ে শৃঙ্খলার সাথে ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে জড়ো হই। সেদিনই সান্ধ্যআইন (কারফিউ) জারি করে দেয়া হয়।





পরবর্তী ঘটনাপঞ্জি





এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আইয়ুব খান ঘোষণা করেন তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন না।





এর মাঝে ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে ডক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়। ২০ তারিখে কারফিউ ভঙ্গ করে মশাল মিছিল করা হয় এবং ২১ তারিখ ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে।





এই আন্দোলনের জেরে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ মামলার অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়া হয়। এখন যেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত, সেখানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি তাকে সম্বর্ধনা দেয়া হয় এবং ভূষিত করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে।





সেখানেই সেদিন শেখ মুজিব জানান, তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে এগারো দফা দাবি তুলে ধরবেন।





তোফায়েল আহমেদ এর ভাষায়, "বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তিনি যদি ছয় দফা না দিতেন আগরতলা মামলা হতো না, এই মামলা না দিলে গণঅভ্যুত্থান হতো না, এই গণঅভ্যুত্থান না হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না, আর তিনি মুক্তি না পেলে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হতাম না।"





"আর তিনি যদি নির্বাচনে বিজয়ী না হতেন, তাহলে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না," এভাবেই মি. আহমেদ ব্যাখ্যা করেন ঘটনাক্রমকে।





মাহ্‌বুব উল্লাহ বলেন, তখন ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজাদ, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ - এসব পত্রিকায় প্রতিদিন এই আন্দোলনের খবর বেরুতো গুরুত্ব সহকারে।





তিনি মনে করেন, এই আন্দোলন শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে নয়, বরং কৃষকদের মধ্যে, শ্রমিকদের মধ্যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল - ফলে তা হয়ে উঠেছিল গণঅভ্যুত্থান।


Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!