এগারো দফা |
এগারো দফা | ||||||
১। | (ক) | সচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকীকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হইবে। | ||||
(খ) | শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজসমূহকে সত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষা প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্সিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে। | |||||
(গ) | প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আই.এ, আই.এস-সি, আই.কম ও বি.এ, বিএস-সি, বি.কম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এম.এ ও এম.কম ক্লাস চালু করিতে হইবে। | |||||
(ঘ) | ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না। | |||||
(ঙ) | হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল ও কেন্টিন খরচার শতকরা ৫০ ভাগ সরকার কর্তৃক ‘সাবসিডি’ হিসাবে প্রদান করিতে হইবে। | |||||
(চ) | হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধান করিতে হইবে। | |||||
(ছ) | মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু করিতে হইবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে। | |||||
(জ) | অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে। | |||||
(ঝ) | মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিনেন্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। | |||||
(ঞ) | প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ, ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সুব্যবস্থা, প্রকৌশল ছাত্রদের শেষবর্ষেরও ক্লাশ দেওয়ার ব্যবস্থাসহ সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। | |||||
(ট) | পলিটেকনিক ছাত্রদের ‘কনডেন্সড কোর্সের’ সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিস্টার পরীক্ষার ভিত্তিতেই ডিপ্লোমা দিতে হইবে। | |||||
(ঠ) | টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আই.ই.আর ছাত্রদের দশ-দফা; সমাজ কল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এম.বি.এ ছাত্রদের ও আইনের ছাত্রদের সমস্ত দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ‘ফ্যাকাল্টি’ করিতে হইবে। | |||||
(ড) | কৃষি বিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কনডেন্সড কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। | |||||
(ঢ) | ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধাসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। | |||||
(ণ) | চাকুরীর নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে। | |||||
(ত) | কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে। | |||||
(থ) | শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিল করিতে এবং ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে। | |||||
২। | প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক- স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে। | |||||
৩। | নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে: | |||||
(ক) | দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম। | |||||
(খ) | ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ। | |||||
(গ) | দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে। | |||||
(ঘ) | সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোনো কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে। | |||||
(ঙ) | ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির এক্তিয়ারাধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আমদানি-রপ্তানি চলিবে। এবং ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রপ্তানি করিবার অধিকার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে। | |||||
(চ) | পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষী বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।</nowiki> | |||||
৪। | পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব-ফেডারেশন গঠন করিতে হইবে। | |||||
৫। | ব্যাংক-বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে। | |||||
৬। | কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হইবে। | |||||
৭। | শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করিতে হইবে। | |||||
৮। | পূর্ব-পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে। | |||||
৯। | জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নিবর্তনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে। | |||||
১০। | সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে। | |||||
১১। | দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে রুজুকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে। |
বাধ্য হন।
গণ-আন্দোলন চলাকালে উচ্চারিত স্লোগানগুলোই ছিল সত্তরের নির্বাচনের পূর্বাপর অর্থাৎ একাত্তরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের সময়কার বহুল উচ্চারিত ও গণজাগরণে প্রেরণাদায়ক সঞ্জীবনী বাণী। সর্বোপরি এই আন্দোলন বাঙালি ছাত্র-জনতাকে একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করেছিল।
এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বাংলার মানুষ তাদের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় প্রদান করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনেই বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
এই নির্বাচন বাঙালিদের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সৃষ্টির লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ণের সুযোগ তৈরি করে এবং বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকার গঠনের অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তার ক্রীড়ণকেরা নানা তালবাহানা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করলে বাঙালিরা এক দফা অর্থাৎ চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের দিকে ধাবিত হয়।
সত্তরের নির্বাচনী রায় না মানার ফল হিসেবে আসে ঐতিহাসিক সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা,- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সংঘটিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। সারা দেশের (বাংলাদেশ) প্রশাসন, ব্যাংক, বিমা, ডাক ও তার বিভাগ, আদলত, বেতার-টেলিভিশন সবকিছুই চলে কেবল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। সঙ্গে চলতে থাকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি।
এগারো দফা
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান ভুটো গং বাঙালিদের চিরতরে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা করে। ২৪ মার্চ সকাল থেকেই বঙ্গব্ধুর কাছে খবর আসতে থাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুরসহ বিভিন্নস্থানে পাক সেনারা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। ২৫ মার্চ কালো রাতে শুরু হয় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর তা প্রতিরোধের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য আসে বঙ্গবন্ধুর ডাক।
ইয়াহিয়া খান প্রথমে ভেবেছিল, বাঙালিদের প্রস্তুতির পাশাপাশি তাঁরাও প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন এবং শেখ মুজিব স্বাধীনতার সরাসরি ডাক দেওয়া মাত্র শুরু হবে হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চাইলেন পাকবাহিনী আগে আক্রমণ শুরু করুক। এরই মধ্যে তিনি তৈরি করে রাখেন স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর ক্যাম্প, পুলিশ ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যার সংবাদ পেয়েই তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের গোপন স্থানে চলে যাবার নির্দেশ দেন এবং বিশেষ ব্যবস্থায় টেলিফোন ও একান্ত বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে অয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা-যা রাতের মধ্যেই পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে।
পরদিন ২৬ মার্চের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের আনাচে কানাচেসহ বহির্বিশ্বে। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠাবার ঘণ্টা দেড়ের মধ্যে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ। রাত প্রায় ১টা ২০ মিনিটে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় স্বাধীনতার মহান স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। সেই থেকে দীর্ঘ প্রায় নয় মাস অর্থাৎ ’৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালিরা অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। মূলত ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের ফল ছিল সত্তরের নির্বাচন, আর ওই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের অনীহা ও চক্রান্ত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত নাটকীয়তার মুখোমুখি হয় যখন ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু'জন প্রধানমন্ত্রী। "এক ইউনিট কাঠামো" নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভুট্টো মুজিবের ৬-দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। মুজিব সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন:
- অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
- সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে হবে।
- নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে।
- ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। তার এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা কোনো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। যদিও ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বুনতে শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করা হয়। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার আহবানে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে যায়। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, কিন্তু এতে আন্দোলন প্রশমিত হয়নি। ৫ দিন হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
- ১.৭মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক
- সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়, কিন্তু কোন বাঙালি বিচারপতি তাকে শপথ পাঠ করাতে রাজি হন নি। পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হতে থাকে। ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরীভিত্তিতে "সরকারি যাত্রী" পরিবহন করতে। এই "সরকারি যাত্রী"দের প্রায় সবাই ছিল সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেনা। এমভি সোয়াত নামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। কিন্তু বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল বাঙালি প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে, যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ। অনেক আশা সত্বেও মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয় নি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত প্রদান করে সন্ধ্যায় গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রা করেন।
- ১.৮গণহত্যা ও জনযুদ্ধের সূত্রপাত
- ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের গণহত্যাযজ্ঞ। এশিয়া টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী,[২৬]
- সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন "তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো, তখন দেখবে বাকিরা আমাদের হাত চেটে খাবে।" সে পরিকল্পনা মতোই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।
- হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। তারপরও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, বাঙালি হত্যা পুরো দেশজুড়ে চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল - জগন্নাথ হল - পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছে, তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনলজি (বর্তমান বুয়েট) এর প্রফেসর নূরুল উলা।
- পুরো বাংলাদেশেই হিন্দু এলাকাগুলো বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মধ্যরাতের আগেই ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো। ২ আগস্ট, ১৯৭১ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, "হিন্দুরা, যারা মোট শরণার্থীদের তিন-চতুর্থাংশ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল"।