গনতন্ত্র বাস্তবায়ন ও স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সকল গণবিরোধী শক্তি ও সামরিক আমলাদের কর্তৃত্বকে অবসানের লক্ষ্যে 1969 সালে পূর্ব বাংলার ছাত্র শ্রমিক কৃষক ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করে তাই ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান।
বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরক্ষাসহ সর্ার্বিক ক্ষেত্রে যে শোষণ নির্যাতন ও বৈষম্য চলে আসছিল তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইউব খানসহ তাঁর দোসররা ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবকে বন্দী করে এবং ছয় দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন শুরু করে।
এর মধ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি ও সামরিক বেসামরিক অন্য ৩৪ জনকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য) করে আইউব সরকার। সরকার ভেবেছিল এই মামলার মাধ্যমে জনগণকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাবে।
কিন্তু জনগণ এই মামলাকে বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন দমানোর জন্য শেখ মুজিব ও অন্যদের ফাঁসানোর সরকারি ষড়যন্ত্র বলে মনে করে। ফলে ছয় দফার পক্ষে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চাঙা হয়ে ওঠে। কারাগার থেকে শেখ মুজিবের অনুরোধে তৎকালীন ন্যাপ নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অংশগ্রহণ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
ভাসানীসহ প্রগতিশীল ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন। ৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বিরোধী দলগুলোর ঢাকায় আহুত হরতালের সময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হয়। ৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছয় দফার পাশাপাশি সম্পূরক হিসেবে ১১ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে এবং ছয় ও ১১ দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে।
এতে যুক্ত হয় শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেওয়া হাজারো ছাত্র-জনতার সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মুখোমুখি সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়।
২৪ জানুয়ারি ছিল প্রতিবাদ দিবস। ওইদিন সচিবালয়ের এক নম্বর গেটে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শেখ রুস্তম আলী, মকবুল ও মতিউর রহমান নিহত হন। এ ছাড়া আরও কয়েক জায়গায় তিনজন নিহত ও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটলে আন্দোলন বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে ওঠে। এদিন ছাত্র-জনতা বেশ কয়েকটি সরকারি অফিস, আন্দোলনবিরোধী ভুমিকা রাখা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিস, আগরতলা মামলার প্রধান বিচারক এস রহমানের বাসা ইত্যাদিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এভাবে দিনটি গণ-অভ্যুত্থান দিবসে পরিণত হয়। গণ-আন্দোলনের দিনগুলোতে স্লোগান উচ্চারিত হয় ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা-শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, জেলের তালা ভাঙব-শেখ মুজিবকে আনব’, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-মানি না মানব না’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি।
১৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে বন্দী অবস্থায় আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা এবং সার্জেন্ট ফজলুল হককে আহত করা হলে ছাত্র-জনতা আরও ফুঁসে উঠে। পরদিন সামরিক বাহিনীর টহল ও জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে কড়া হরতাল পালন করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যার পর আন্দোলন এমন চরমে পৌঁছে যে, সরকার জনতার এ আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তি দেয়। মুক্তি লাভের পর দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে এদেশের ছাত্র-জনতার পক্ষে তোফায়েল আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
বস্তুত ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সোপান। এই আন্দোলন বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করে এবং সামরিক শাসক আইউব খানের পদত্যাগ ত্বরান্বিত করে। আইউবের পর সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এলেও দাবি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের তীব্রতা উপলব্ধি করে তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সত্তরের নির্বাচন দিতে এগারো দফা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্যের পটভূমিতে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির বাস্তবায়ন এবং অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আইউব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথম দিকেই লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলনের সূচনা হলেও বঙ্গবন্ধুসহ গণহারে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের এবং আওয়ামী লীগ কর্মিদের উপর নির্যাতনের ফলে ছয়দফা কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরই পটভূমিতে গড়ে উঠা পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) ও ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) যখন স্বৈরাচারী আইউব সরকারের বিরুদ্ধে