স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৬৬-১৯৭১

Joynal Abdin
0

ভূমিকা:





স্বাধীনতা হলো একটি রাষ্ট্রের আজন্ম লালিত স্বপ্ন। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হওয়ার মধ্যে যেমন গৌরব থাকে তেমনি পরাধীনতায় থাকে গ্লানি। আর তাই পরাধীন হয়ে কেউ বাঁচতে চায় না। দাসত্বের শৃঙ্খলেও কেউ বাঁধা পড়তে চায় না। বাঙালি জাতিও চায়নি বছরের পর বছর ধরে শাসনে-শোষণে পাকিস্তানিদের দাস হয়ে থাকতে। তাই তারা শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে, সোচ্চার হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বীর বাঙালি ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতাকে। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, লাখো বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছে এ দেশের স্বাধীনতা। মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছে তার সর্বস্ব। কিন্তু সব হারিয়েও তারা অর্জন করেছে স্বাধীন সার্বভৌম স্বপ্নের একটি দেশ-বাংলাদেশ।





প্রেক্ষাপট:





১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বাঙালি জাতি কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র পায়নি। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানির কখনোই পূর্ব পাকিস্তানকে সমমর্যাদা দেয়নি। বরং সব সময়ই চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখতে। এ যেন রাষ্ট্রের ভেতরে আর এক গোলামী রাষ্ট্র। পশ্চিম পাকিস্তানির সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যে জর্জরিত করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানকে। পণ্যের কাঁচামাল, উৎপাদন, আয়, রপ্তানি আয় পূর্ব পাকিস্তানে বেশি হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যয় হতো খুবই সামান্য। দেশের মোট ব্যয়ের সিংহ ভাগই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যেখানে ৯৫% ব্যয় হত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ব্যয় হত ৫ শতাংশ। ১৯৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই বাঙালির হাতে শাসনভার তুলে দিতে চায়নি। ফলে এই সকল প্রকার বৈষম্যের কারণে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।





বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ:





বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদের সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণার প্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঐদিন ভাষার দাবীতে রাজপথে নিহত হয় রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। ভাষার দাবীতে জীবন দিতে হয়, রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর একটিও নেই। ভাষা ও সংস্কৃতিতে যখন আঘাত আসে তখন বাঙালি বুঝতে পারে তাদের স্বাতন্ত্র্যকে। তারা ‘বাঙালি জাতি’ এই পরিচয় তাদের মধ্যে দৃঢ় হতে শুরু করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ সময় গঠিত হয় বেশ কিছু সংগঠন। ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২’র শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচনে বিপুল ভোটে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়, এই প্রত্যেকটি ঘটনার মাধ্যমে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত স্বীকৃতি লাভ করে।





ছয় দফা আন্দোলন





ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের  ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ২৩ মার্চ।





ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেলরাষ্ট্র ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ফেডারেলরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ন স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়।বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালির মুক্তির সনদও বলা হয়।





প্রতি বছর ৭ই জুন বাংলাদেশে ৬ দফা দিবস' পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন।





ইতিহাস





ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ রপ্তানি (যেমন পাট) হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এর ফলে, অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা বৈষম্য সম্পর্কে প্রশ্ন বাড়াতে শুরু করে এবং ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রদান করে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া হলঃ





বছরপশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় (কোটি রুপি)পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় (মোট শতাংশ)পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় (কোটি রুপি)পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় (মোট শতাংশ)
% জনসংখ্যা৩৬.২৩৬৩.৭৭
১৯৫০-৫৫১,১২৯৬৮.৩১৫২৪৩১.৬৯
১৯৫৫-৬০১,৬৫৫৭৫.৯৫৫২৪২৪.০৫
১৯৬০-৬৫৩,৩৫৫৭০.৫১,৪০৪২৯.৫০
১৯৬৫-৭০৫,১৯৫৭০.৮২২,১৪১২৯.১৮
মোট১১,৩৩৪৭১.১৬,৫৯৩২৮.৮৪




৬ দফার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্বাধীন বাংলাদেশ





৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ৬ দফার মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। ৬ দফা না হলে কোনদিন ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান হতো না। আর গণ-অভ্যুত্থান না হলে সত্তরের নির্বাচন হতো না এবং নির্বাচন না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না, মুক্তিযুদ্ধ না হলে দেশ স্বাধীন হতো না। এই ৬ দফা ছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত এবং ন্যায্য সুবিধাবঞ্চিত বাঙালী জাতিকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য বাঙালিদের প্রাণের দাবি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন।





একটি কঠিন সত্য এই যে, ৬ দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের বেশ কিছু সিনিয়র নেতা বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। অনেকের ধারণা ছিল ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে স্বক্ষম হবেন না। তার দল আওয়ামী লীগ ধ্বংস হবে। কিন্তু বাস্তবে এই ৬ দফার কারণেই শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু জাতির জনক, সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ৬ দফার কারণে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। রাজনীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে যে কি আকাশ চুম্বি সফলতা অর্জন করা যায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করেছেন।





৬ দফা পাওয়ার পরই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী জ্বলে উঠল, বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিল। এর প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালে নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালি যুব, ছাত্র ও আপামর জনতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হলে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান, যিনি দীর্ঘ দশ বছর দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে শাসন কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন, বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের শাসনভার তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে দিয়ে পদত্যাগ করেন।





৬ দফার সেই ঐতিহাসিক ৭ জুন কাল। সময়ের প্রেক্ষাপটে ৬ দফা আজ নতুন করে বিশ্লেষণের দাবী রাখে। কারণ এই ৬ দফাই একটি চূড়ান্ত স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নিয়ে যায় আমাদের। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই ৬ দফা ও ৬ দফার ঐতিহাসিক সত্যটুকু পৌছে দেওয়া জরুরী। যেহেতু ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত ৬ দফা আন্দোলনই ছিল তদানীন্তন দেশের রাজনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু।





৬ দফার জন্য ৭ জুন মাইলফলক এ কারণে যে, ১৯৬৬ সালের এই দিনে ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে হরতাল পালন করা হয়। এতে পূর্ববাংলায় তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্র“য়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে। কিন্তু এই সম্মেলন তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে ভারতবিরোধী হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর এই দাবির প্রতি আয়োজকের পক্ষ থেকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ৬ দফা উত্থাপন করেন। এ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুকে `বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা` বলে চিহ্নিত করা হয়। পরে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ১৩ মার্চ ৬ দফা এবং এ ব্যাপারে দলের অন্যান্য বিস্তারিত কর্মসূচি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করিয়ে নেন।





কী ছিল এই ৬ দফায়? বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায় ৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পুর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধাসামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হবে।





বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় উত্তর দেয়া হবে। এদিকে ৬ দফা কর্মসূচি জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সমগ্র পূর্ববাংলা সফর করেন এবং ৬ দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে অভিহিত করেন।





বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ গণসংযোগে অংশ নেন। প্রতিটি জনসভায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ফলে শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে। যশোর, ময়মনসিংহ এবং সিলেটসহ অন্য কয়েকটি স্থানে ৬ দফার পক্ষে প্রচারকালে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন।





১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের এক জনসভায় ৭ জুন হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জুন মাসব্যাপী ৬ দফা প্রচারে বিপুল কর্মসূচি নেয়া হয়। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক মনু মিয়া গুলিতে শহীদ হন। এতে বিক্ষোভের প্রচন্ডতা আরো বেড়ে যায়। আজাদ এনামেল অ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে শহীদ হন। একই দিন নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ৬ জন শ্রমিক। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়। হাজার হাজার আন্দোলনকারী মানুষ গ্রেপ্তার হয়। বহু জায়গায় জনতা গ্রেপ্তারকৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের রক্তে আন্দোলনের নতুন মাত্রা গড়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের আন্দোলন।





বাঙালির মুক্তির সনদ হচ্ছে এই ৬-দফা। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পেশের মাধ্যমে যেমনি পাক ভারত উপমহাদেশের জনগণ ব্রিটিশ শোষকদের এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য ঐক্যমত হয়েছিল, ঠিক তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের এইদিনে ঘোষিত ৬-দফাকে তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণ পশ্চিমাদের এদেশ থেকে তাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আইয়ুব খানের পতন, ১৯৬৯ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জাতির জনকসহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তি আন্দোলনের প্রধান মনোবল ছিল এই ৬-দফা। সর্বোপরি ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনীত প্রার্থীদের একচেটিয়া রায় প্রদান করে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।





নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন সরকার গঠনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য গড়িমড়ি শুরু করলো তখনই মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণের মাধ্যমে। আরো একটি ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ৭ মার্চের ভাষণেও ৬-দফার প্রতিটি দফার পর্যালোচনা ছিল। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকার বিভিন্ন সেক্টরের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়েছিল ৬-দফার ভিত্তিতে। এতে এটা বলা যায় যে, ৬-দফা মানেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।





 





১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিসমূহ





  • প্রস্তাব - ১ :




শাসনতান্ত্রিক কাঠামো রাষ্ট্রের প্রকৃতি:





দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারনের সরাসরি ভোটে।









  • প্রস্তাব - ২ :




কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:





কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু'টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।





  • প্রস্তাব - ৩ :




মুদ্রা বা অর্থ-সমন্ধীয় ক্ষমতা:





মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু'টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-





(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু'টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।





অথবা





(খ)বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।





  • প্রস্তাব - ৪ :




রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:





ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।





  • প্রস্তাব - ৫ :




বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:





(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।





(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।





(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।





(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।





(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।





  • প্রস্তাব - ৬ :




আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:





আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।


Tags:

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!