রাজশাহী নগরের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বুথ স্থাপন করে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষায় যাঁদের করোনা পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের বেশির ভাগই উপসর্গহীন। দিনাজপুর, জয়পুরহাট, খুলনা ও যশোরেও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মানুষের মধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা নিয়ে আগ্রহ, উদাসীনতা দুই-ই দেখা গেছে। জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগলেও পরীক্ষা করতে চান না অনেকে।
কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না, সেটি র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমেও নিশ্চিত হওয়া যায়। সরকার বিনা মূল্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। একটি কিটের সাহায্যে মাত্র কয়েক মিনিটেই পরীক্ষাটি সম্পন্ন করা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখন দেশে
৫১০টি পরীক্ষাকেন্দ্রে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। আর যক্ষ্মা শনাক্তে ব্যবহৃত কার্টিজ বেজড নিউক্লিক অ্যাসিড অ্যামপ্লিফিকেশন টেস্ট (সিবি ন্যাট) বা জিন এক্সপার্ট পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হচ্ছে ৪৪টি কেন্দ্রে। ৩৩৪টি স্থানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে।
গত বছরের ৫ ডিসেম্বর দেশের ১০ জেলায় করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর কয়েক ধাপে আরও জেলা ও উপজেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও বেশি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। অ্যান্টিজেন পরীক্ষার বিষয়ে উপজেলা ও গ্রামীণ এলাকার লোকজন জানে না। যেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে, সেখানে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। জনগণকে পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা যেখানে পরীক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা নিয়ে রয়েছে উদাসীনতা। সামাজিক বিড়ম্বনার কারণে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত অনেকেই করোনা পরীক্ষায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাতোর এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ রায় জানান, কয়েক দিন ধরে তিনিসহ তাঁর পরিবারের সবাই জ্বর-কাশিতে ভুগছেন। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবনে কিছুটা উন্নতি হলেও পুরোপুরি সুস্থ হননি। এ অবস্থায় চিকিৎসক তাঁদের করোনা পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দিলেও তাঁরা করাননি। প্রদীপ রায় বলেন, পরীক্ষার পর করোনা ধরা পড়লে বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেবে। বাড়ির লোকজন ঝামেলায় পড়বে।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন দিনে গরম আর ভোররাতে ঠান্ডা অনুভূত হয়। এমন আবহাওয়ার কারণেও এটা হতে পরে। তবে এলাকায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা সতর্ক আছি।’
পাঁচ দিন ধরে রাজশাহী নগরের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বুথে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চলছে। প্রথম দুই দিন কাজটি করে সিভিল সার্জনের দপ্তর। তিন দিন ধরে এই দায়িত্ব পালন করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা নগরের মোট ১৩টি পয়েন্টে এই পরীক্ষা চালাচ্ছে।
বুথের স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ আছে। আসছেনও অনেকে। পরীক্ষায় যাঁরা পজিটিভ হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো উপসর্গ নেই। এটা উদ্বেগের। কারণ, উপসর্গহীনেরা নিজেদের অজান্তেই করোনা ছড়াচ্ছেন।
রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট বুথে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছিলেন সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সুপার মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই বুথে গতকাল বৃহস্পতিবার ১০১ জনের মধ্যে ২৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এঁদের কারোরই কোনো উপসর্গ ছিল না। তাঁরা নিজের অজান্তেই অন্যদের সংক্রমিত করছেন।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, পাঁচ দিন ধরে নগরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চলছে। শনাক্তও হচ্ছে। এঁদের বেশির ভাগেরই উপসর্গ নেই। বেশি মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি নিজে থেকেই আলাদা হয়ে যাবেন। এতে অন্তত তাঁর পরিবারসহ আশপাশের মানুষকে তিনি সংক্রমিত করবেন না।
যশোরে নয়টি সরকারি হাসপাতালে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা অব্যাহত রয়েছে। ঈদের পর অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। ছয় মাসে যশোরে ২ হাজার ৭৬২ জনের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ৬৯৬ জনের ফলাফল পজিটিভ এসেছে। গত বুধবার যশোরে ১৩৯ জনের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ৪৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আরিফ আহমেদ বলেন, এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০টি করে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে। গতকাল ৩৩ জনের পরীক্ষা করে ১৭ জনের পজিটিভ ফল এসেছে।
জেলার কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গতকাল ১৫টি অ্যান্টিজেন্ট পরীক্ষার মধ্যে ৬ জন করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ২৯ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৫ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। দুজন রোগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, পরীক্ষার বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কম।
জয়পুরহাট পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে বিশেষ ক্যাম্প করে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। বুধবার জেলায় এক দিনে ৪৩৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। গতকাল সকালে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় ২৭৮টি এবং বগুড়া পিসিআর ল্যাবে জয়পুরহাটের ১৫৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় ৭৫ জনের এবং পিসিআর ল্যাবের পরীক্ষায় ২৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
জয়পুরহাট পৌরসভার মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল দুপুরে বলেন, পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ছোট একটি মহল্লায় ৪৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়।
দিনাজপুরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মানুষদের মধ্যে যাঁদের জ্বর-সর্দি-কাশি আছে, তাঁদের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে। সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসের শেষ দিকে এই অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০টি অ্যান্টিজেন পরীক্ষার কিট সরবরাহ করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ৪২৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৮ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে।
খুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু হয়। প্রথমে শুধু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই পরীক্ষা হতো। মে মাসের প্রথম দিকে খুলনা সদরসহ জেলার নয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়। এ জেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ আছে বলে স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন।
খুলনা স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, জেলায় মোট ১১টি করোনা শনাক্তকরণ কেন্দ্রে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে। যেসব রোগীর জ্বর, সর্দি, কাশি ও গলাব্যথার মতো উপসর্গ রয়েছে, শুধু তাঁদেরই অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হয় এসব স্থানে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৭০ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে। শেষ তিন দিনে জেলায় মোট ৫০৬টি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩টি নমুনায় করোনা পজিটিভ এসেছে। শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।